পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশ: এক ধরনের মশকরা !!

প্রকাশঃ এপ্রিল ১০, ২০১৬ সময়ঃ ১:৪০ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১১:৫৩ পূর্বাহ্ণ

zahid-1

পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ : দেশের ৯৯ ভাগ মানুষের জন্য যা দুঃসাধ্য, সেটাকে জাতীয় সংস্কৃতির অংশ করা এক ধরনের মশকরা ! মাছে-ভাতে বাঙ্গালিয়ানা নিয়ে কবি ঈশ্বর গুপ্ত বলেছিলেন, ‘ভাত-মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙ্গালি সকল/ ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল।’ বাঙালির মাছ খাওয়ার সপক্ষে প্রধানতম যুক্তি হলো — বাংলার মাটি, বাংলার জল বাঙালিকে যে খাদ্য সরবরাহ করে, সেটাই স্বাভাবিক আহার্য। বঙ্গজীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে শুধু মাছ আর মাছ। জন্ম-বিবাহ-মৃত্যু পর্যন্ত সকল মাঙ্গলিক পার্বন থেকে শুরু করে দৈনন্দিন আটপৌরে ব্যবহারে মাছের বাঙালির মাছের অনুপস্থিতি বিরল। আর সেটিা যদি হয় মনমাতানো গন্ধ মাছের রাজা ইলিশের মচমচে ভাজা, তাহলে কোন কথাই নেই। হাজারো মত-পথে বিভক্ত বাঙ্গালির সব মত-পথ নি:সন্দেহে ইলিশে এসে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। কিন্তু পহেলা বৈশাখ এলেই ইলিশ নিয়ে যে উন্মাদনাটা তৈরি হয় এবং একশ্রেণির ব্যবসায়ীকে আমরা অতি মুনাফা খাওয়ার পথ করে দিই, আমার বিরোধিতাটা ঠিক সেখানে। এটা কোনভাবে্ই পান্তা-ইলিশের বিরোধিতা নয়।

ইলিশের দামটা যেদিন উচ্চ বা মধ্যবিত্তের নয়, বরং সাধারণের নাগালে আসবে, মোটামুটি সবসময় চাল-ডাল, শাক-শব্জি, অন্যান্য মাছ-মাংসের মতো হাট-বাজার থেকে এক-আধটা ইলিশ কিনে গ্রাম বাংলার লোকজন বাড়ি ফিরতে পারবে, সেদিন থেকে ইলিশকে পহেলা বৈশাখের একটি সার্বজনীন সংস্কৃতির অংশ হিসেবে যুক্ত করা যেতে পারে! অন্যথায় এটা হবে গরীব চাষা-ভূষা বাংগালীর উপর দু-কলম ‘নেকাপড়া’ শেখা এলিট শ্রেণীর চাপিয়ে দেয়া একটি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন! এমনিতে যাদের সামর্থ্য আছে, তারা ইলিশ কেনো ‘তিমি’ কিনে খাবে, তাতে কার কী! কিন্তু পহেলা বৈশাখে ১৬ কোটি বাংলাদেশীর (ওপাড়ের বাংগালি দাদাদের কথা না হয় আপাতত বাদই দিলাম) কয়জনের পাতে ইলিশ তো দূর অস্ত, ইলিশের কাটা জোটে ?

কেউ যদি মনে করেন, ইস্যুটা নিয়ে আতলামি করা হচ্ছে, বাঙ্গালি সংস্কৃতির বিরোধিতা করা হচ্ছে, তাদের জন্য আফসোস হচ্ছে! তাদেরকে শুধু বলবো, দাদা ভাই/দিদি ভাইরা, সারাজীবন ‍শুধু খেয়েই গেলেন, বাঙ্গালির মন-মানসিকতা; চাওয়া-পাওয়া; না পাওয়াটা বুঝলেননা, বোঝার চেস্টাও কখনো করলেন না। এখানে মুশকিলটা কোন ‘আতলামির’ না, সার্বজনীন একটা বিষয়কে আমাদের পহেলা বৈশাখের সংস্কৃতির মধ্যে অন্তর্ভুক্তি করা, না করা নিয়ে! যেমন ধরুন না, ঈদ, বড়দিন, পূজা বা হোলি উৎসবে নতুন কাপড়, পিঠা-পায়েস, গোশত, মিঠাই, প্রসাদ, চকলেট আমরা যেমন নিজেরা নিজেদের রুচি মতো গ্রহন করি, তেমনি যাদের সামর্থ্য নেই বা যারা অভ্যাগত তাদের মাঝেও সাধ্যমতো এসব খাবার, পোশাক ইত্যাদি বিলিয়ে দিয়ে উৎসব-আনন্দকে সার্বজনীন করা হয়! প্রসঙ্গক্রমে, চীন, ইরানসহ অন্যকিছু দেশের নববর্ষ, নওরোজ, বর্ষবরণের আয়োজনগুলো আমরা পর্যবেক্ষণ করতে পারি! এসব দেশের বর্ষবরণ কেমন করে সার্বজনীনভাবে উদযাপন করা হয়! তাদের ঐতিহ্যগুলো আমাদের বাংলা নববর্ষের চেয়েও অনেক প্রাচীন! অথচ কোন বৈষম্য নেই! অথচ পহেলা বৈশাখে ইলিশের স্বাদ, গন্ধ, কাঁটাও আমাদের কৃষক-মজুর, আধাবেলা খাওয়া=উপোষ দেওয়া গ্রাম বাংলার দরিদ্র জনগোষ্টিকে উপহাস করে। এটি ‍সুস্পষ্টভাবে এক ধরণের শ্রেণী বৈষম্য তৈরি করছে।

গান-বাজনা, কুলা-ডালা, নাড়ু-মুড়ি-মুড়কি পহেলা বৈশাখে আমাদের ঐতিহ্যের অংশ হলেও পান্তা-ইলিশ স্রেফ ভাড়ামি অার গুটি কয়েক মাুনষের শতভাগ ব্যবসায়িক ধান্ধা। বৈশাখের প্রথম দিনে ইলিশ খাওয়াটিা কেমন জানি একদিনের বাঙ্গালী সাজার মতো ব্যাপার। সারা বছর কোটি টাকার গগনচুম্বী ভবনের কোন শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ফ্লাটে কিংবা দামী কোন রেস্ট্যুরেন্টে ফার্মের মুর্গীর নরম হাড় চিবিয়ে সেই ব্যক্তিরাই যখন পহেলা বৈশাখে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ীতে করে, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাজার থেকে ইলিশ কিনে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার সঙ(!)স্কৃতি উদযাপন শুরু করে, তখন বিষয়টি হাস্যকর লাগে। এই ইস্যুতে যখন আবার গলা মাতায়, তখন, তাদেরকে সার্কাসের ক্লাউন ছাড়া অন্য কিছু মনে হয়না।

দেশের ৯৯ ভাগ মানুষের পক্ষে যেটা করা দুঃসাধ্য, সেটাকে জাতীয় সংস্কৃতির অংশ করাটা এক ধরনের তামাশা।

আমার প্রস্তাব হচ্ছে, কেউ যদি নিজের গাটের টাকায় ইলিশ কিনে সেটা পান্তা ইলিশ, ভাপা ইলিশ, ইলিশ পোলাও, ইলিশ ফ্রাই, ইলিশ কোর্মা, ইলিশ পাতুরী…..যে কোন স্বাদে আস্বাদন করতে চায়, করবে, কারো কিছু বলার নেই! কিন্তু জীবন যাদের কাছে ‘হর রোজ রোজা’, যাদের কাছে পহেলা বৈশাখ আর পহেলা চৈত্রের মাঝে কোন তফাত নেই, যেসব ‘কুবের মাঝিরা’ নির্ঘুম রাত জেগে নদী-সাগরের লোনা জল, মিঠাজল সেকে দু’বেলা দু’মুঠো নিজেদের উদোর পূর্তির জন্য এলিটদের পাতে ইলিশটা তুলে দেয়, পহেলা বৈশাখে যদি কাংগালি ভোজের মতো পান্তা ইলিশ নিজেরা খাবার পাশাপাশি তাদের মাঝেও বিতরন করা যায়, যদি এমন একটা সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, যেখানে সবার পাতে কম-বেশি ইলিশ উঠবে; পহেলা বৈশাখে ইলিশ সংস্কৃতি অব্যাহত থাকা নিয়ে অন্তত আমার মতো সাধারণ বাংলাদেশিদের কোন আপত্তি থাকবেনা! তখন না হয় কলাপাতা, শালপাতা কিংবা মাটির বাসন-কোষন নিয়ে আমরাও ইলিশের গন্ধে সব ভেদাভেদ ভুলে কারো বাড়ীর দরজায় দাঁড়িয়ে তাক্ তা্ক্ করে কড়া নাড়বো আর গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করবো : এসো হে বৈশাখ, এসো এসো…..

লেখক: জাহিদ-আল-অামিন

========

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G